বাংলাদেশী কমিউনিটি এসোসিয়েশান অফ নোভা স্কসিয়ার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন
বাংলাদেশী কমিউনিটি এসোসিয়েশান অফ নোভা স্কসিয়ার উদ্যোগে ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ত্যারিখে কানাডার নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের রাজধানী শহর হালিফাক্স এ বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা যথাযথ মর্যাদায় নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একটা মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান পালন করেছে। গৃহিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল মাননীয় মেয়র মাইক সেভেজ এর হালিফাক্স আঞ্চলিক পৌরসভা তে ’২১ শে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর ঘোষপত্র প্রদর্শন, ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র প্রদর্শনী, অস্থায়ি শহীদ বেদীতে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি, শিশুদের চিত্রাংকন , পুরষ্কার বিতরণ এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মাননীয় মেয়র মাইক সেভেজ ডাকযোগে প্রেরিত ঘোষণাপত্রে হালিফাক্স আঞ্চলিক পৌরসভা তে ’২১ শে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর ঘোষণা দিয়ে যথাযথ মর্যাদার সাথে বলেছেন বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে “ প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন “ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস করে। ২১ আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের চিন্তা চেতনা ঐতিহ্য, আমাদের অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ- সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সারা বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় রফিক, শফিক, বরকত ও সালামের তরতাজা রক্ত বৃথা যায়নি। সেই থেকে বিশ্বের ১৮৮ দেশে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হচ্ছে।
মাননীয় মেয়র মাইক সেভেজ এর এই ঘোষণা পত্রের জন্য বাংলাদেশী কমিউনিটি এসোসিয়েশান অফ নোভা স্কসিয়ার পক্ষ থেকে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর হাই কমিশনার মিজানুর রহমান এর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য, গত ৩১ শে জানুয়ারি ২০১৮ হালিফাক্সে বাংলাদেশ হাই কমিশনের এক দিনের নাগরিক সেবা প্রদান করা হয় এবং মাননীয় হাই কমিশনার মিজানুর রহমান মাননীয় মেয়র মাইক সেভেজ এর সাথে আন্তরিক বৈঠকে ’২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর ঘোষণা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন এবং বাংলাদেশী কমিউনিটি এসোসিয়েশান অফ নোভা স্কসিয়াকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। বাংলাদেশী কমিউনিটি এসোসিয়েশান অফ নোভা স্কসিয়া হালিফাক্স এ বসবাসরত সমস্ত বাংলাদেশী দের এই ব্যপারে সহযোগিতার জন্য প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে সকলকে কৃতিত্ব প্রদান করে। এ সিদ্ধান্তকে সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের গৌরব বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশী কমিউনিটি এসোসিয়েশান অফ নোভা স্কসিয়া হালিফাক্স এর আযহারুল হক। একুশ কেবল শোক নয়। শক্তি এবং অর্জনেরও একটি দিন। ২১ এর অন্যতম মৌলিক বিষয় ছিল একটি অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য।পবিত্র কোরআন পাঠের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অনুষ্ঠানেরশুভ সূচনা করা হয়। এরপর সমবেত কণ্ঠে আগত অতিথি বৃন্দ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত গেয়ে শোনান। অস্থায়ি ভাবে নির্মিত শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে ভাষাশহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সর্বস্তরের মানুষ।
কানাডায় ফটোগ্রাফী ও চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত নাদিম ইকবালের প্রথম ছবি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘মাদার টাং’ প্রদর্শন করা হয়। কিছু ভাষাগোষ্ঠী নিজ নিজ ভাষার চর্চা নিজেদের মধ্যে ধরে রাখলেও সিংহ ভাগ হারিয়ে ফেলেছে তাদের পূর্ব পুরুষের ভাষা ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। মনিস রফিক এর ভাষায় বলতে হয়, মানুষের প্রবাহমান জীবনে মানুষ এগিয়ে চলে সামনে আর এই এগিয়ে চলায় বড় কোনো আশ্রয়ের কাছে মাথা নত করতে গেলে প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলে নিজেদের ভাষা, নিজেদের প্রথা আর সংস্কৃতিকে। সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘মাদার টাং’ নানা-নাতনীর আখ্যান। নানা গভীর ভালোবাসায় তাঁর নাতি-নাতনীদের নিয়ে বসেন তাঁর লেখাগুলো শুনানোর জন্য, তিনি জানাতে চান তাদের বাংলা ভাষার ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস। দেখা যায় খুব সহজ বাংলা শব্দ তাদের কাছে অজানা আর ওমন ইতিহাস ও গল্পের প্রতি তাদের গভীরতম মনোযোগের একটা অভাব। অনেক আনন্দের মধ্যে এক বেদনাবোধ কাজ করে নানার মধ্যে, আর তা হচ্ছে, তাঁর নাতি-নাতনীরা বাংলা ভাষা কী ভুলে যাবে বা তিনি যা লেখেন তা কী তারা ভবিষ্যতে পড়তে সক্ষম হবে ? ভাষা-সমস্যার জন্য তারা কী তাঁর লেখার আস্বাদ নেয়া থেকে বঞ্চিত হবে? নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে নিজের উত্তরসুরীদের ধীরে ধীরে সরতে থাকা এক ভাষার প্রধানতম কবির এই মনোবেদনা সত্যি এক করুণ আবহ তৈরী করেছে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে।
ডঃ আহসান হাবিব (ডালহৌসি ইউনিভার্সিটি) মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য বিষয়ে তাঁর বক্তব্বে সভার উদ্দেশ্য, প্রকল্পের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে বিভিন্ন আলোচক বৃন্দের সাথে আগত প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিচয় করিয়ে দেন। সভায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের একুশের চেতনায় মূল প্রবন্ধ আলোচক ছিলেন অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক পালেরমো (ডালহৌসি ইউনিভার্সিটি), জনাব লিউস মাককিনন (নির্বাহী পরিচালক, গায়েলিক অ্যাফেয়ার্স), জনাব ওয়াইন হামিল্টন (নির্বাহী পরিচালক, আফ্রিকান নোভা স্কসিয়া অ্যাফেয়ার্স)। এছাড়া শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন এম এল এ মিস রাফাহ ডিকস্তানজো ।
জনাব লিউস মাককিনন তাঁর মাতৃভাষা সংরক্ষন ও উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা ও সুজুগ সংক্রান্ত আলোচনায় গায়েলিক ইতিহাস তুলে ধরে বলেন এই ভাষা ১৯ শতাব্দীতে ২য় বৃহত্তম ভাষা ছিল এই প্রদেশে যা বিংশ শতাব্দীতে হারিয়ে যেতে থাকে। তিনি বলেন, ঐতিহ্যগত গালিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গৈরিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন আত্মীয়তা, পরিদর্শন অভ্যাস, হাস্যরস এবং সঙ্গীত এবং নাচ খুব আকর্ষণীয়। গালিক সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যে নোভা স্কোয়া প্রদেশে গেইল একটি জাতিগত সাংস্কৃতিক উপস্থিতি হিসাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সংস্কৃতির মাধ্যমে তাদের ভাষা পুনঃসংযোগের মাধ্যমে গালিকের পরিচিতির পুনরুজ্জীবনের জন্য পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। এই ব্যপারে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষার প্রবাহকে অব্যাহত রেখে সংস্কৃতি প্রকাশের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে লিউস মাককিনন উল্লেখ করেন।
জনাব ওয়াইন হামিল্টন তাঁর “আফ্রিকান নোভা স্কটিনস সাংস্কৃতিক সম্পর্ক” প্রবন্ধে উল্লেখ করেন পারিবারিক ভিত্তি, সাংস্কৃতিক ভিত্তি, মেটা-ভৌত ভিত্তি – এই তিন ধরনের ভিত্তির সাথে ভাষা সংযুক্ত। কিছু ভাষাগোষ্ঠী নিজ নিজ ভাষার চর্চা নিজেদের মধ্যে ধরে রাখলেও সিংহ ভাগ হারিয়ে ফেলেছে তাদের পূর্ব পুরুষের ভাষা ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। জনাব হামিল্টন তাঁর প্রবন্ধে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেন কিভাবে আফ্রিকান সম্প্রদায় তাদের শিকড় কে ভুলে গিয়েছে পুরোপুরি। বড় বড় জাতি কেড়ে নিয়েছে আফ্রিকানদের নিজেদের ভাষা, নিজেদের প্রথা আর সংস্কৃতিকে। উনি উপলব্ধি করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন এর গুরুত্ব এবং সেই সাথে সমস্ত জাতি গুষ্ঠিকে এক সাথে কাজ করার অনুরধ জানান।
অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক বলেন মাতৃভাষাই একজন মানুষের পরিচয়ের শ্রেষ্ঠতম উৎস। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিশেষ কোনো মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে, তুলে ধরে তার জাতিসত্তার পরিচয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার ফলে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ আত্মরক্ষা এবং আত্মবিকাশের সুযোগ পেল। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সাহসী ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের মনে হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে পৃথিবীর সব ভাষা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আলোচনা সভার পর এম এল এ মিস রাফাহ ডিকস্তানজো শিশুদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন।
আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। স্থানীয় শিল্পী ও শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে একুশের শোকগাথা নিয়ে পরিবেশন করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের সুরে শিশুদের শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করে। গান গেয়ে শোনান আমিনুল ইসলাম, নাগিব প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত ছবিগুলুর জন্য মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান শান্তা আনোয়ার এবং প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির হোসাইন এর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
Recent Comments